সবুজ নিস্বর্গের বুকে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। প্রেস বক্স থেকে বেরিয়ে আয়রন ব্রিজ দিয়ে তাকালেই আরেক সবুজের সমারোহে চোখ আটকে যাবে। যা মুগ্ধতা ছড়াবে, মনে প্রশান্তি দেবে।

নবনির্মিত সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ড-২-ও সবুজের গালিচায় মোড়ানো। আছে কৃষ্ণচূড়া গাছ, যা মাঠকে করেছে সুশোভিত। সব মিলিয়ে একই আঙিনায় দুই ক্রিকেট গ্রাউন্ড গড়ে উঠেছে, যা দেশের ক্রিকেট অবকাঠামোতে আর কোথাও নেই।

প্রকৃতির কোলে ক্রিকেটানন্দ
একদিকে উঁচু-নিচু টিলা, অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত চা-বাগান। দুইয়ের মাঝে সবুজের আচ্ছাদন। সবুজ পাহাড়-টিলা আর নয়নাভিরাম চা বাগানবেষ্টিত স্টেডিয়ামে ব্যাট-বলের ঠুকঠাক শব্দ, সকালের মিষ্টি রোদ ও বিকেলের ঠাণ্ডা হাওয়া যেকোনো ক্রিকেটপ্রেমীর জন্য এ যেন নৈঃস্বর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বাতাবরণ! প্রকৃতির কোলে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম দেশের স্পোর্টস ট্যুরিজমের বড় বিজ্ঞাপণ। এ স্টেডিয়ামের পাশেই গড়ে উঠছে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম গ্রাউন্ড-২।

২০১৯ সালে স্টেডিয়ামের ভিত্তিপ্রস্ত স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন নাম দেওয়া হয়েছিল আউটার স্টেডিয়াম। পরবর্তীতে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম গ্রাউন্ড-২। ২০২১ সালে এর পথ চলা শুরু। ১০০১ টাকা নামমাত্র মূল্যে পাওয়া ৮.৭৩ একর জায়গায় গড়ে উঠেছে স্টেডিয়ামটি। দৃষ্টিনন্দন স্টেডিয়ামটি তৈরিতে খরচ হয়েছে ২৮ কোটি টাকা।

অবকাঠামো চোখ জুড়িয়ে দেয়
স্টেডিয়ামটির সবথেকে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে গ্রিন গ্যালারি। অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার স্টেডিয়ামগুলোর একপাশে দর্শকরা উন্মুক্ত মাঠে খেলা দেখেন। সেখানে শুয়ে-বসে খেলা উপভোগ করেন ক্রিকেটপ্রেমিরা। সিলেটেও সেই সুযোগটি পাওয়া যাবে। মাঠের পশ্চিমপাশের একটি টিলাকে কৃত্রিম উপায়ে গ্যালারির মতো করে তৈরি করা হয়েছে। ঘাস লাগিয়ে সেটাকে সবুজের গালিচায় রূপ দেওয়া হয়েছে। উপরে উঠার জন্য দেওয়া হয়েছে সিঁড়ি। এছাড়া ধস ঠেকাতে প্রতিটি ধাপে ইট-কংক্রিটের ভিত্তিও দেওয়া হয়েছে।

সুযোগ সুবিধায় ‘টপ ক্লাস’
এই মাঠটি সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক আদলে তৈরি। মাঠের পুরোটা জুড়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বিশ্বমানের। রয়েছে ৮টি উন্নতমানের উইকেট (হানড্রেড ব্লক)। যদিও এ নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নই রয়েছে। নতুন এই গ্রাউন্ডটিতে রয়েছে চারটি উন্নতমানের ড্রেসিং রুম। খেলোয়াড়দের ডাইনিং রুম সম্পূর্ণ আলাদা। খেলোয়াড়দের জন্য আইস বাথসহ রয়েছে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা।

এছাড়াও সাংবাদিক, আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারিসহ অফিসিয়ালদের জন্যও আছে পৃথক রুম। ভিআইপি দর্শক কিংবা বিসিবির আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য হসপিটালিটি বক্সের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। গ্রাউন্ড-১ এর সঙ্গে গ্রাউন্ড-২ এর সংযোগ স্থাপনে নির্মাণ করা হয়েছে ‘আয়রণ ব্রিজ।’ যা দুই স্টেডিয়ামকে সংযোগই করেননি। আশেপাশের পরিবেশকেও সুন্দর করেছে।

রয়েছে সারা বছর অনুশীলনের সুবিধা
ভারতের রাজকোটের সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মূল মাঠে উইকেট ৮টি। সারাবছর সেগুলো পরিচর্যা করা হয়। আর স্টেডিয়ামের বাইরের গ্রাউন্ডে অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা বিস্তৃত। মাঠের পেছনে মোট ২৫টি অনুশীলন উইকেট। যে উইকেটগুলো আছে, সেগুলোও আবার বিভিন্ন প্রকারভেদে। কোনোটা বাউন্সি, কোনোটা স্লো, কোনোটা স্পিন সহায়ক, কোনোটা পেস সহায়ক। আবার কোনোটায় ঘাস আছে, কোনোটা একেবারে পাটা। যার যখন যে উইকেটে অনুশীলন করার প্রয়োজন, সব বন্দোবস্ত রয়েছে এখানে। সিলেটেও সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। রয়েছে ৬টি উইকেট (হানড্রেড ব্লক)। বিভাগীয় ক্রিকেটাররা নিয়মিত এখানে অনুশীলনের সুবিধা পান। তাদের জন্য সারাবছর সেগুলো পরিচর্যা করা হয়।

আরো যা যা হবে…
স্টেডিয়ামের পাশেই অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একাডেমিক ভবন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। বিসিবির আঞ্চলিক একাডেমির ক্রিকেটাররা থাকবেন সেই ভবনে। যেখানে থাকবে ডরমেটরি, সুইমিংপুল, জিমনেশিয়াম, ইনডোর প্র্যাকটিস ফ্যাসিলিটি। এজন্য মূল স্টেডিয়ামের গ্রিন গ্যালারির পেছনে আরও ৩ একর জায়গা নেওয়ার জন্য আবেদন করেছে বিসিবি। ৩ একর জায়গায় অনুশীলনের সুযোগ সুবিধা থাকবে। ৩-৪টি স্লটে বিভিন্ন দল অনুশীলনের সুযোগ পাবে। কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেখানে মাটি ও সিমেন্টের ৯টি উইকেট তৈরি করা হবে। যার ফলে একই দিনে ১২০ জন খেলোয়াড় ৩ স্লটে অনুশীলন করতে পারবে। তাতে প্রথম বিভাগীয় দলগুলোকেও অনুশীলনের সুযোগ দেওয়া যাবে। সব মিলিয়ে পুরো প্রকল্প এলাকায় হবে টোটাল স্পোর্টস এরিনা।

কিন্তু উইকেট?
আউটার স্টেডিয়ামে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ম্যাচে চিরাচরিত বাংলাদেশের উইকেটের চিত্র ফুটে উঠেছিল। ঢাকা ও সিলেটের প্রথম দিনই ২১ উইকেট গিয়েছিল। পরদিনই ম্যাচ শেষ। পরের ম্যাচগুলোর গল্প প্রায় একইরকম। তবে উইকেটকে খুব বাজে বলছেন না ম্যাচে ১০ উইকেট পাওয়া নাজমুল ইসলাম অপু, ‘উইকেট বাজে না। হয়তো স্পিন ফ্রেন্ডলি। কিন্তু এখানেও রান হয়েছে পরে। সেদিন আসলে ব্যাটসম্যানরা বাজে শট বেশি খেলছিল। সেই সুযোগগুলোই বোলাররা নিয়েছে।’

তবে বাঁহাতি স্পিনারের কথার সঙ্গে পরিসংখ্যানের খুব একটা মিল নেই। জাতীয় লিগে অনুষ্ঠিত হওয়া ৬ ম্যাচে দলীয় সর্বোচ্চ রান খুলনার ৪১৯, যে ম্যাচে নাহিদুল করেছিলেন ১৭৫ রান। এছাড়া সেঞ্চুরি আছে ফজলে রাব্বী ও সালমান হোসেনের। আর এক’শর নিচে দলীয় রান আছে দুইটি। কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের লংগার ভার্সনের ম্যাচও রান খরায় ভুগেছে। তিন ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ দলীয় রান ২৬২। উইকেট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা ঘাসের চারা রোপন করা হয়েছে এখানে।

লাক্কাতুরা এলাকায় প্রকৃতির কোলে পরম মমতায় শুয়ে থাকা স্টেডিয়াম দুটি হতে পারে পর্যটন শিল্পেরও অন্যতম বিজ্ঞাপন। নিয়মিত ম্যাচ আয়োজন, আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, আশেপাশের পরিবেশের উন্নয়ন ও বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে এগোলো ক্রিকেট ও পর্যটন প্রেমিদের চোখের মনি হয়ে থাকবে এই ক্রীড়া কমপ্লেক্স।

বিসিবির পরিচালক ও স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেছেন, ‘আমরা পুরোপুরি একটা স্পোর্টস অ্যারিনায় এটাকে রূপ দিতে যাচ্ছি। এজন্য ৩ একর জায়গা নতুন করে পাচ্ছি। আমরা যা যা চাচ্ছি, যেসব পরিকল্পনা করছি সব ধীরে ধীরে পূরণ হচ্ছে। আমাদের আত্মতুষ্টি এই জায়গায় যে, আমরা করে দেখিয়ে দিয়েছি যে আমরা পেরেছি। আমাদের এটা মডেল হিসেবে নিয়ে অন্যরাও করুক। স্পোর্টস মিউজিয়াম উচ্চভিলাষী স্বপ্ন হলেও আমরা শুরু করবো ছোট করে। ইউনিক কিছু করার চেষ্টা করবো যেন সবাই সেটা অনুসরণ করে।

 

কলমকথা/সাথী